Home » ছাগলের পেছনে ক্যামেরার স্বপ্ন: এক স্বপ্নবাজ সৌখিন খামারির ছাত্রজীবনের সফলতার গল্প

ছাগলের পেছনে ক্যামেরার স্বপ্ন: এক স্বপ্নবাজ সৌখিন খামারির ছাত্রজীবনের সফলতার গল্প

স্বপ্নের খামার বাড়ি: ছাগল পালন দিয়ে শুরু, স্বপ্নের গন্তব্য।

 শুরুটা যেভাবে,

জীবনে লাভ লোকসান হিসাব গুনে কি হবে,এক জীবনে পৃথিবীর সব প্রাপ্তির আপনার ঝুলিতে কখনো উঠবে না। মনের সুখ ই আসল সুখ। চলুন গল্পে যাই,

আমি তখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। ভাবলাম পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে কিছু একটা করা দরকার। যা থেকে আমার সময় ও কাটবে পাশাপাশি বাড়তি আয় ও হবে। সেটা শখের কিছু হলে ভালো হয় , তাহলে শখ ও মিটলো আয় ও হলো ।আমার তখন ক্যামেরা কেনার খুব শখ ছিল। কিন্তু ক্যামেরা কেনার মত হাতে এতো টাকা ছিল না। তখন চিন্তা করলাম একটা বাচ্চা ছাগল কিনি, কিছুদিন পালন করলে ছাগল বড় হবে বাচ্চা দিবে ।বাচ্চা ও মা ছাগল  বিক্রি করলে যথেষ্ট টাকা হবে ঐ টাকা দিয়ে এরপর ক্যামেরা কিনবো।

যেই চিন্তা মাথায় এলো ওমনি কাজে নেমে পড়ি। তখনই সিদ্ধান্ত নিই—ছাগলই হবে আমার অবসর সময়ের সঙ্গী।

ছাগল পালনের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন আছে কি?

হ্যাঁ অবশ্যই অভিজ্ঞতা প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমার তো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তখন আমি গুগল করে জানতে চেষ্টা কেমন ছাগল কিনতে হবে?দাম কেমন হবে? ছাগল সুস্থ কিনা বুঝবো কিভাবে? ছাগল কি খায়? ছাগল রাখবো কোথায়? যে ভাবে কিনবো সেই ভাবে চাইলে বিক্রি করতে পারবো কিনা? আমার পরিবেশ এর সাথে মানানসই হবে কিনা? কোন জাত কেনা উচিত? এমন নানান প্রশ্ন মাথায় আসে আর এগুলো জানার চেষ্টা করি ধীরে ধীরে শিখি।

চলুন এবার জেনে নিই আমি ছাগল কেনার টাকা কোথায় পাই?

আমি যেহেতু ছাত্র স্বভাবতই আমার কাছে টাকা থাকার কথা নয়। হ্যাঁ তখন আমার একটা ভালো অভ্যাস ছিল। আমি কারণ ছাড়াই অল্প অল্প করে টাকা জমা করতাম। সারা বছর জমিয়ে প্রায় ২৭০০ টাকা জমায় । খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি একটা ভালো মানের ছাগলের বাচ্চা কিনতে ৩-১০ হাজার টাকা প্রয়োজন। তখন আমি আমাদের ছোট্ট একটা পুকুরে মাছের চাষ করতাম। সেই মাছ বিক্রির ১ হাজার টাকা আমার হাতে ছিল।সব মিলিয়ে ৩৭০০ টাকা। আমি আমার প্রথম বর্ষের ফুল সেট বই কেনার জন্য আব্বুর থেকে টাকা নিই। কিন্তু আমি দুইটা বই কম কিনি। আপাতত যে কয়টা বই কিনছি ঐ গুলো পড়ি এবং হাতে টাকা হলে বাকি দুটো কিনে নিবো। ঐ বই না কেনা টাকা যুক্ত করে আমার ফান্ডিং দাঁড়ায় ৪ হাজার টাকা।

চলুন এবার জেনে নিই আমি কিভাবে ছাগল কিনি?

প্রথমে আমি আমার আশেপাশে কিছু ছাগল দেখি। তখন  ছাগল এবং দাম কোনোটাই আমার মন মত হয় নি। কিনতে না পেরে কিছু দিন কয়েকটা হাঁট ঘুরে দেখি,তাও পছন্দ মত ছাগল পাই নি তাই কেনা হয় নি।

অবশেষে ফেইসবুকে এক খামারি ভাইয়ের বিজ্ঞপ্তি দেখি। তিনি কিছু ছাগল বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন। ওনার সাথে যোগাযোগ করে ওনার খামারে গেলাম। কয়েকটি ছাগলের বাচ্চা পছন্দ হয় কিন্তু সাধ্যের বাহিরে হওয়ায় নিতে পারি নি।

শেষমেষ একটা ছাগল পছন্দ করি,যেটা দেখতে তত সুন্দর ছিল না। কিন্তু জাত ভালো মনে হয়ে ছিল। দামাদামি করে ৪ হাজার টাকায় কিনে বাড়ি আসি। সময় টা ছিল ১৯ এপ্রিল ২০১৯

ছাগল কিনেই তো শেষ নয়, এবার ছাগল রাখবো কোথায়?

ছাগল রাখার জন্য তো ঘর প্রয়োজন। না হয় ছাগল চুরি হতে পারে, কুকুর,শেয়াল, মেছোবাঘ আক্রমণ করতে পারে।তাই শুরুতে কিছু দিন নিজেদের থাকার ঘরের একপাশে রাখার ব্যবস্থা করি। এরপর ঘর নির্মাণ করি।

ছাগলের ঘর নির্মাণ যেভাবে করবেন?

ছাগল রাখার জন্য বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না, ছাগল অল্প জায়গায় রাতে থাকতে পারে।

ঘর নির্মাণ:

কয়টি ছাগল পালন করবেন সেই অনুযায়ী হিসাব করে ঘর তৈরি করবেন। ছাগলের জন্য মাচা বানিয়ে ঘর তৈরি করা উত্তম। মেঝে থেকে মাচার উচ্চতা দিতে হবে কমপক্ষে ৩-৪ ফুট উঁচু করে। না হলে ছাগলের ঘনঘন ঠান্ডা জনিত সমস্যা লেগেই থাকবে। কাঠ অথবা সুপারি গাছ দিয়ে মাচা তৈরি করলে ভালো হয়। ছাগলের ময়লা পড়ে যাওয়ার জন্য মাচায় ফাঁকা রাখতে হবে আধা ইঞ্চি করে। ছাগল রাখার জন্য ঘরের মধ্যে ১২-১৬ বর্গফুট জায়গাই যথেষ্ট। ঘর দক্ষিণ মূখী করে করলে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা ভালো হয়, পরিষ্কার রাখা সহজ হয়। ছাগল উঠা নামার জন্য ঢালু করে সিঁড়ি তৈরি করতে হবে। আর মেঝেতে বালু দিয়ে রাখলে পরিবেশ দূর গন্ধ মুক্ত এবং শুষ্ক থাকবে।

খাদ্য ও পরিচর্যা:

একটা প্রবাদ আছে, পাগল কিনা বলে,ছাগলে কিনা খায়। আমি ও তাই মনে করে ভুল করি। খায় ঠিক আছে কিন্তু সব খাদ্য ছাগলের জন্য নয়।

আমি যেহেতু নতুন ছিলাম শুরুতে প্রচুর ভুল করি। আমি আপনাদের গাইড করবো যাতে ভুল না করেন। ছাগল তৃণভোজী প্রাণী। এদের প্রধান খাবার ঘাস, লতাপাতা, বিভিন্ন গাছের পাতা।

কিন্তু আমি শুরুতে ফলমূল, অতিরিক্ত দানাদার খাদ্য দিই যা দফায় দফায় ছাগলের পেটে সমস্যার কারণ হয়।

চলুন জেনে নিই ছাগল কে কি খাবার দিবেন:

  • ছাগলের খাবারে আঁশ জাতীয় খাদ্য রাখতেই হবে।
  • প্রতিদিন সবুজ ঘাস খেতে দিবেন।
  • সাথে লতাপাতা ও বিভিন্ন গাছের পাতা দিবেন ।
  • আর প্রতি ২০ কেজি ওজনের ছাগলের জন্য ২৫০ গ্ৰাম দানাদার খাদ্য দিবেন।
  • পরিমিত বিশুদ্ধ পানি দিবেন।

জাতভিত্তিক পরামর্শ?

কোন জাতের ছাগল কিনবেন? বা কোন জাতের ছাগল কেনা লাভ জনক?

ব্ল্যাক বেঙ্গল: 

এই জাত টি আমাদের দেশের লোকাল জাত। আকারে ছোট। এই জাতের ছাগলের মাংসের মান ভালো। খুব সুস্বাদু। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। প্রতিবারে ২-৪ টি বাচ্চা দেয়।

যমুনাপাড়ি : 

বড় দেহ, লম্বা কান দুধ ও মাংসের জন্য বিখ্যাত। বছরে ১ বার বাচ্চা দেয়। প্রতিবারে ১-৩ টি। আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী।

বিটল :

দুধ বেশি দেয়, ছাগল বেশ বড় হয় ,কান লম্বা,চোখ সাদা টাইপের হয় । দেখতে ছোট খাটো গরুর বাচ্চার মত। প্রতিবারে ১-৩ টি বাচ্চা দেয়।

আমাদের আবহাওয়া উপযোগী জাত।

হরিয়ানা: 

দেখতে বেশ সুন্দর একটা জাত। বেশ বড় হয় বিটলের মত।দুধ ও মাংসের জন্য বিখ্যাত।প্রতিবারে ২-৩ টি বাচ্চা দেয়। বছরে একবার বাচ্চা দেয়। শিং বাঁকানো হয়,কান কলার খোসার মতো ভাঁজ হয়ে থাকে।কান ১ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।

মুখ একটু বাঁকানো হয় ।

তোতাপুরী:

আমাদের দেশের খামারীদের কাছে একটি জনপ্রিয় জাত । আকারে বেশ বড় হয়। এর চোয়াল এর কারণে এতো জনপ্রিয়। দুধ ও মাংস উৎপাদন ক্ষমতা বেশ ভালো। প্রতিবারে ১-৩ টি বাচ্চা দেয়।১৪-১৬ মাসে দুইবার বাচ্চা দেয়। বাচ্চার দাম অনেক, দেশে বাচ্চার চাহিদা ভালো।

তবে আমি পরামর্শ দিবো, শুরুতে ক্রস জাতের ছাগল পালন করুন ।শুরুতে নামকরা জাতের ছাগল কিনতে গেলে খরচ বেশি পড়বে। তাছাড়া মাংসের বাজারে সব ছাগলের দাম সমান। শেখার জন্য ক্রস ই ভালো। ক্রস জাতের ছাগল দুধ ভালো দেয়, বাচ্চা বড় হয়,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো,দাম কম , সহজেই যে কোনো পরিবেশে রাখা যায়।

প্রজনন:

  • ছাগলের বাচ্চা ৬-৮ মাসে প্রজনন এর জন্য উপযুক্ত হয়।
  • স্ত্রী ছাগল বছরে ২ বার বাচ্চা দেয় বললেও মূলত ১৪-১৬ মাসে দুইবার বাচ্চা দেয়।
  • জাত বুঝে একবারে ১-৪ টি বাচ্চা প্রসব করে।

তবে দুটি বাচ্চা দেওয়াই ভালো। এতে বাচ্চা সঠিক ভাবে দুধ পায় এবং দ্রুত বড় হয়। পাশাপাশি লালন পালন সহজ হয়।

কেমন পাঠা নির্বাচন করবেন?

আপনার ছাগীর সাইজ অনুযায়ী পাঠা দিয়ে প্রজনন করাবেন। খেয়াল রাখবেন পাঠা যাতে বেশি বড় না হয়।বেশি বড় জাতের পাঠা দিয়ে প্রজনন করালে ছাগীর নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাচ্চা প্রসবের সময় মা ছাগলের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হবে।যার ফলে ছাগল দূর্বল হয়ে পড়বে।তাছাড়া বাচ্চা দেওয়ার পর বাচ্চার চাহিদা অনুযায়ী দুধ কম পাবে।

গর্ভবতী ছাগল ও প্রসবের পর বাচ্চার যত্ন:

গর্ভে থাকাকালীন শেষ দুই মাসে বাচ্চার গ্ৰোথ বেশি হয়,ঐ সময় মা ছাগলের আলাদা যত্ন নিতে হয়। বেশি করে সুষম খাদ্য পরিবেশন করতে হয়।

প্রসবের পর বাচ্চাকে পরিষ্কার শুকনো কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কোনো ক্রমেই পানি দিয়ে গোসল করানো যাবে না। এতে ঠান্ডা লেগে বাচ্চা মারা যেতে পারে। প্রথম দুই ঘন্টার মধ্যে বাচ্চাকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। মা ছাগল কে কচি নরম ঘাস দিতে হবে প্রথম কয়েক দিন।  প্রথম ৭ দিন বাচ্চা কে দুধ খাওয়াতে সাহায্য লাগতে পারে। আলাদা যত্ন করতে হবে। আর শীতে বাচ্চা দিলে বাচ্চা কে আলাদা ভাবে তাপ দিয়ে উষ্ণ রাখতে হবে।

এখন ছাগলের ডাকেই জেগে ওঠে ভোর, আলাদা করে এলাম এর প্রয়োজন পড়ে না।

শুরুতে উদ্দেশ্য ভিন্ন থাকলেও এখন আমি ছাগল প্রেমী হয়ে গেছি। অবশ্য সকল প্রাণীকূলের প্রতি আমার আলাদা ভালো লাগা ভালোবাসা কাজ করে। আমি পশু পাখিতে আসক্ত।

ছাগল পালনে লাভ কেমন হয়?

ওহ হো লাভের কথা তো বলাই হয় নি। ২০১৯ সালে যে একটা ছাগল দিয়ে শুরু করি । এরপর আমি আর ছাগল কিনি নাই। প্রতি বছর কোরবানির সময় ছাগল বিক্রি করি। প্রতিটি খাসি ছাগল ১৯-২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে।

সব কিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। 

সামনে লাভ আশাকরি বাড়বে।

মাশাআল্লাহ পড়ুন!

“মাশাআল্লাহ_”

ছাগল পালনে খরচ কেমন?

ছাগল পালনের খরচ আপনার উপর নির্ভর করে। আপনি খরচ যত কমাতে পারবেন লাভ তত বেশি করতে পারবেন। আমার দানাদার খাদ্যের বেশির ভাগ উপাদান আমরা নিজেরাই উৎপাদন করি এতে খরচ কম পড়ে। আর টুকটাক কৃমিনাশক, ভিটামিন মিলিয়ে মেডিসিন খরচ। আর ঘর নির্মাণে এককালীন খরচ সব মিলিয়ে খুব বেশি নয়।

ও হ্যাঁ আমার গ্র্যাজুয়েশন ও কম্পিট করা হয়ে গেছে। পাশাপাশি ছাগল পালনের উপর প্র্যাকটিক্যাল ডিগ্ৰী টা ও কম্পিট হয়ে গেছে । নানান সীমাবদ্ধতায় আমি ছাগল পালন বানিজ্যিক ভাবে করতে পারি নি,এটা শখের মধ্যে ই পড়ে আছে। 

মূল কথা,

  আমি যে উদ্দেশ্যে নিয়ে ছাগল পালন শুরু করি ,তা আর পূরণ করা হয় নি। লাভ আমি যথেষ্ট করেছি কিন্তু শখের ক্যামেরা আর কেনা হয় নি।

শেষ কথা,

ছাগল পালন শুধুমাত্র মুনাফার হিসাব নয়, এটা প্রকৃতি, সময়, আর জীবনের সঙ্গে যুক্ত এক সুন্দর বন্ধন। সব হিসাব টাকা দিয়ে হয় না।আবেগ ভালোবাসা ই আসল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *