Agro

বাংলাদেশের কৃষি ও দরিদ্রদের দুষ্ট চক্র

♥ পরিচিতি:

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ।শ্রমশক্তি জরুরি ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী,এই দেশের শতকরা ৪৫ শতাংশ মানুষ কৃষি জাত পেশার সাথে জড়িত । এই তালিকায় যুক্ত আছেন কৃষক, কৃষি শ্রমিক,গবাদি পশু পালনকারী,মাছ চাষী, বাগান মালিক, কৃষি পরামর্শক, কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবসায়ী, কৃষি প্রকৌশলী, কৃষি পণ্য সরবরাহ কাজে নিয়োজিত শ্রমিক।এই পেশাগুলো কৃষিখাত ও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে ।

বাংলাদেশের কৃষিজাত পেশা সমূহের মধ্যে অন্যতম প্রধান পেশা নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হল:

♣কৃষক: যারা জমিতে সরাসরি চাষাবাদের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করেন তারাই মূলত কৃষক ।যেমন ধান, গম, পাট, ভূট্টা ,মুগ, মাষকলাই, খেসারি, সয়াবিন, সূর্যমুখী, সরিষা, শশা,গাজর ,টমেটো,পটল ,আলু ,মূলা এবং অন্যান্য শস্য উৎপাদনকারী।

♣ কৃষি শ্রমিক: যারা কৃষকের ফসলী জমিতে ফসল উৎপাদনে কৃষক কে সহায়তা করেন। যেমন জমি চাষ, জমিতে নিড়ানি দেওয়া,আগাছা পরিষ্কার,সেচ, ফসল সংগ্রহ ,ফসল প্যাকেজিং,ফসল বাজারজাত করণ ও অন্যান্য শারীরিক শ্রম।

♣গবাদিপশু পালনকারী: যারা গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া পালন করেন এবং দুধ, মাংস, ও পশুর অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করেন তারাই গবাদি পশু পালনকারী।

♣মাছ চাষি : যারা অল্প জায়গায় বাণিজ্যিক ভাবে বেশি মাছ উৎপাদন করেন তারাই মূলত মাছ চাষী।যেমন: জলজ প্রাণী বা মাছের পুকুরের ব্যবস্থাপনা করেন।

♣ বাগান মালিক : যারা বিভিন্ন ধরনের ফল, ফুল, শাকসবজি বা অন্যান্য বাগানজাতীয় পণ্য চাষ করেন তাঁরাই মূলত বাগান মালিক।

কৃষি পরামর্শক : যারা কৃষকদের উন্নত প্রযুক্তি ও চাষাবাদ কৌশল সম্পর্কে কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে পরামর্শ দেন তাঁরাই কৃষি পরামর্শক।যাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়,বিষ মুক্ত ফসল উৎপাদন হয়, বাজার জাতের সঠিক নিয়ম বজায় রাখে ।

♣কৃষি সরঞ্জাম ব্যবসায়ী : যারা কৃষির জন্য আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি বিক্রি করেন তারাই হচ্ছে কৃষি সরঞ্জাম ব্যবসায়ী।

♣কৃষি প্রকৌশলী : যারা কৃষির প্রযুক্তিগত উন্নতি, সেচ ব্যবস্থা, মাটি স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এবং আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সময় ও ব্যয় কমিয়ে আনা নিয়ে কাজ করে থাকেন।

 

বাংলাদেশের কৃষিতে উন্নতি না হওয়ায় কারণ:

প্রাকৃতিক দুর্যোগ: 

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এই দেশে প্রায় সারা বছরই দূর্যোগ লেগেই থাকে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বৈরী আবহাওয়া ইত্যাদি। যা কৃষিজ উৎপাদন ব্যবস্থায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

অতিবৃষ্টি: 

কোনো স্থানের স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হওয়া কে অতিবৃষ্টি বলা হয় । সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে টানা বৃষ্টি বা অল্প সময়ে অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাতের কারণে ঘটে থাকে । অতিবৃষ্টির ফলে জলাবদ্ধতা, ফসলহানি, যোগাযোগ ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে ‌।

অনাবৃষ্টি: 

কোনো স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া কে অনাবৃষ্টি হিসাবে ধরা হয়। এতে বৃষ্টির সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি লক্ষ করা হয়। এটি সাধারণত খরার পূর্বাভাস হিসেবে ধরা হয় এবং কৃষি, পরিবেশ ও মানুষের জীবনযাত্রা ও পশু পাখির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

⇒অনাবৃষ্টির কারণে যেসব সমস্যা দেখা দেয়:

  • তীব্র খরা দেখা দেয়।
  • ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে।
  • পানি সংকট দেখা দেয়।
  • পশু পালনে সমস্যা হয়।
  • গাছ-পালা ও জীববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

⇒ঘূর্ণিঝড়: 

সাধারণত বাংলাদেশ এপ্রিল – জুন এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয় এবং উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। এই সময় প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় গাছ পালা, জমির ফসল, ঘরবাড়ি, পশুসম্পদের ও জান মালের ব্যাপক ক্ষতি করে।

⇒ বৈরী আবহাওয়া:

প্রকৃতির অস্বাভাবিক আচরণের কারণে বৈরী আবহাওয়ার দেখা দেয় । দেখা যাচ্ছে শীতকালে শীতের বিপরীতে গরম পড়ে, গ্ৰীষ্মকালে ভোর বেলায় ঠান্ডা লাগা এমনকি কুয়াশা পড়তে দেখা যায়।আর বর্ষাকালে বৃষ্টি না হয়ে তীব্র গরমে মাঠ ঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ে। প্রকৃতির এই উলট পালট অবস্থাই হচ্ছে বৈরী আবহাওয়া।

⇒ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ না করা: 

এই দেশের বেশির ভাগ কৃষক অশিক্ষিত। তারা সানাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে। সানাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে উৎপাদন হয় কম । উল্টো জমির উর্বরতা নষ্ট হয় । কৃষক জমির স্বাস্থ্য নিয়ে একদম ই ভাবে না। দিনকে দিন উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে ফসল উৎপাদন বেশি হতো।

⇒ পরিকল্পিত চাষাবাদ এবং বাজার ব্যবস্থা না থাকা:

দেখা যায় কোনো ফসল একটু ভালো উৎপাদন এবং ভালো দাম পেলে পরের বছর সব কৃষক মিলে একই ফসল উৎপাদন করে। চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে কষ্টে অর্জিত ফসলের বাজারে কোনো দাম থাকে না।

 

♦ বাংলাদেশের কৃষক দরিদ্র হওয়ার কারণ:

প্রাকৃতিক দুর্যোগ: 

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানি হয় । যার ফলে কৃষক পুঁজি তুলতে না পেরে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।

 

⇒ ক্ষুদ্র ঋণ: 

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কৃষক যখন নিঃস্ব হয়ে পড়ে তখন পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর এবং সাংসারিক ব্যয় মেটানোর জন্য কৃষকের কাছে কিছুই থাকে না। তখন কৃষক ক্ষুদ্র ঋণ নিতে বাধ্য হয়। ঋণের সুদ এবং পুনরায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে, কৃষক ঘুরে দাঁড়ানোর বিপরীতে আরো বেশি ঋণ গ্ৰস্থ হয়ে পড়ে।

⇒ ফসলের ন্যায্য মূল্য: 

বাংলাদেশের কৃষক দরিদ্র এবং ঋণ গ্ৰস্থ হওয়ায় উৎপাদিত ফসল মজুত করতে পারে না। একদিকে সংরক্ষণ করার জন্য গুদাম তৈরির সামর্থ নেই। অন্যদিকে ঋণের বোঝা মাথায় থাকায় ফসলের মাঠ থেকে ফসল নাম মাত্র মূল্যে ব্যাপারির কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

⇒ সানাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ: 

সানাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে ফসল উৎপাদন কম হয়। ফসল উৎপাদন কম হলে লাভ ও কম হয় ।যা দিয়ে কোনো মতে জীবন ধারণ করতে হয়।

⇒ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার: 

দরিদ্র কৃষক চাইলেও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে না। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি,বীজ,সার , ঔষধের দাম অনেক বেশি হয়।যা কৃষকের নাগালের বাহিরে। বিশেষ করে উন্নত যন্ত্রাংশের উচ্চ মূল্যের কারণে বাংলাদেশের দরিদ্র কৃষক ব্যবহার করতে পারে না।

 

⇒ চাষাবাদ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান: 

বাংলাদেশের দরিদ্র কৃষক অশিক্ষিত হওয়ায় চাষাবাদ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে না। ফসলের রোগ বালাই সম্পর্কে সঠিক ভাবে না বুঝার কারণে ভুল বালাইনাশক ব্যবহার করে, ফসলের উল্টা ক্ষতি করে। অনেক যে বালাইনাশক দরকার তা না দিয়ে উল্টো অন্য বালাইনাশক ব্যবহার করে।কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় বালাইনাশকের সঠিক মাত্রা ব্যবহার করে না। আবার সঠিক সময়ে বালাইনাশক জমিতে প্রয়োগে করে না।যার ফলে বালাইনাশক কাজ করে না। এতে ফলস উৎপাদন হ্রাস পায়।

⇒ বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:

পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণে কৃষক বিরাট ভুল করে। দেখা যায় অপরিপক্ক বীজ সংগ্রহ করে।যার ফলে ফসল উৎপাদন হ্রাস পায়। আবার ভালো বীজ সংগ্রহ করতে পারলেও সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে না। ফলে বীজের মান সঠিক থাকে না। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় নানান জাতের বীজের মিশ্রণ করে ফেলে। এতে ফসল উৎপাদন কমে যায়। যার কারণে কৃষক উন্নতি করতে পারে না।

সর্বশেষে,

♦ ফসলের মূল্য নির্ধারণ:

প্রায় সব কৃষক ই উৎপাদন ব্যয় লিপিবদ্ধ করে না। এতে সঠিকভাবে বলতে ও পারে না ঠিক কত টাকা ব্যয় হয়েছে ফসল উৎপাদনে। যার ফলে নিজের উৎপাদনকৃত পণ্যের মূল্য নিজে নির্ধারণ করতে পারে না। এতে লোকসান এর সম্মুখীন হতে হয়।

 

“কৃষি আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কৃষি আমাদের প্রাণ। কৃষিতে আমরা যদি উদাসীন হই পরবর্তীতে আমরা আহার করার জন্য ভালো খাদ্য পাবো না। ধ্বংস করে দিতে পারে আমাদের সুন্দর জীবন।”

 

 

 

 

Meherab Hossain

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may also like

Agro

জৈব সার তৈরির সহজ উপায় ও সুবিধা সমূহ

শুরুতে জেনে নিই জৈব সার মূলত কি? এক প্রকার কার্বন (C) সমৃদ্ধ সার যা প্রাকৃতিক ভাবে উৎপন্ন হয়। সার হল
Agro

কিভাবে করবেন লাভজনক শসা চাষ | সম্পূর্ণ গাইড

শসা চাষ পদ্ধতি (হাইব্রিড ও আধুনিক): বাংলাদেশের মাটিতে এমন কিছু সবজি আছে যা শুধু চাহিদায় শীর্ষে নয়, বরং প্রায় প্রতিটি