লাউ চাষ: সবজি চাষের সহজ ও লাভজনক উপায়
বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় লাউ একটি অত্যন্ত পরিচিত ও লাভজনক সবজি। সারা বছর চাষযোগ্য এই সবজিটি শুধু খেতে সুস্বাদু নয়, বরং পুষ্টিগুণেও ভরপুর। আজ আমরা জানব কীভাবে সঠিক নিয়মে লাউ চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায় এবং কীভাবে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
উন্নত জাত পরিচিতি
লাউয়ের উন্নত জাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- বারি লাউ-১
- নবাব
- নাইচ গ্ৰীন
- সুলতান
- ডায়না
- লাভলী
- ময়না
- মার্শাল
- হাইগ্ৰীন
- ম্যাজিক
- সম্রাট
- বাদশাহ
- বারি লাউ-২,
- বারি লাউ-৩
- বারি লাউ-৪
এসব জাত সারাবছর চাষ করা সম্ভব।
পুষ্টিগুণ:
প্রতি ১০০ গ্রাম লাউ এ রয়েছে:
উপাদান | পরিমাণ |
---|---|
ক্যালসিয়াম | ২৬ মি.গ্ৰা. |
ভিটামিন সি | ৪ মি.গ্ৰা. |
খনিজ পদার্থ | ০.৬ গ্রাম |
খাদ্য শক্তি | ৬৬ কিলো ক্যালরি |
আমিষ | ১.১ গ্ৰাম |
লৌহ | ০.৭ গ্ৰাম |
খাদ্য আঁশ | ০.৬ গ্ৰাম |
শর্করা | ১৫.১ |
বপনের সময়:
বর্ষাকাল:
মধ্য শ্রাবণ থেকে মধ্য কার্তিক (অগাস্ট – অক্টোবর)
বসন্তকাল:
মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ (ফেব্রুয়ারি – মে)
চারা প্রস্তুতি ও রোপণ:
সুস্থ ও দ্রুত চারা পাওয়ার জন্য ৫x৪ ইঞ্চি সাইজের পলিথিন ব্যাগে বালি, মাটি ও পচা গোবরের মিশ্রণে চারা তৈরি করুন। বীজ বপনের জন্য উর্বর, রৌদ্রোজ্জ্বল ও হাওয়াবাতাস চলাচলের সুবিধাযুক্ত জমি বেছে নিন। প্রতি গর্তে ৩-৪টি বীজ পুঁতে দিন।
বীজের পরিমাণ:
শতকপ্রতি ৪-৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন, যা জাতভেদে ভিন্ন হতে পারে।
সারের ব্যবহার (প্রতি শতক):
সারের নাম | পরিমাণ |
---|---|
গোবর | ৪০ কেজি |
ইউরিয়া | ০২ কেজি |
টিএসপি | ১.৬ কেজি |
এমওপি | ১.২ কেজি |
বোরণ | ১০ গ্ৰাম |
পিট তৈরির সময় গোবর, টিএসপি, বোরণ, অর্ধেক এমপি ও পাঁচ ভাগের এক ভাগ ইউরিয়া মাটির সাথে মিশিয়ে নিন। ১০-১৫ দিন পর বপন করুন। বাকি ইউরিয়া ও এমপি চার কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ব্যবস্থাপনা:
লাউ ফসল পানির অভাবে খুব দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুকনো মৌসুমে ৫-৭ দিন অন্তর সেচ প্রয়োজন। প্লাবন সেচ নয়, বরং নালায় পানি আটকে ধীরে ধীরে শোষণের ব্যবস্থা করা উত্তম।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ:
চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর আগাছা পরিষ্কার করুন। গাছ বেশি ঘন হলে পাতলা করে দিন। প্রতি বর্গমিটারে রবি মৌসুমে ৫০-৬০টি ও খরিফে ৪০-৫০টি চারা রাখা ভালো।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিতে হবে। ঝড়ের সময় গাছ খুঁটির সাথে বেঁধে দিন।
কীটনাশক ব্যবস্থাপনা
সাধারণ পোকা দমন
ফলের মাছি, লাল বিটল, সুড়ঙ্গকারী পোকা: সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন: ওস্তাদ/ম্যাজিক/কট) প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ মি.লি. মিশিয়ে ৫ শতকে স্প্রে করুন।
জাবপোকা:
ইমিডাক্লোরোপ্রিড (যেমন: এডমায়ার/টিডো) ৭-১০ মি.লি. ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।
প্রতি ১০-১২ দিন পরপর ২-৩ বার প্রয়োগ করুন।
রোগবালাই দমন:
পাউডারি মিলডিউ: সালফার বা কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করুন।
এনথ্রাকনোজ/ফল পচা: কার্বেন্ডাজিম বা প্রোপিকোনাজল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করুন।
ডাঊনি মিলডিউ: ম্যানকোজেব ভিত্তিক রিডোমিল গোল্ড প্রয়োগ করুন।
পাতার মোজাইক: বাহক জাবপোকা দমনে ইমিডাক্লোরোপ্রিড ব্যবহার করুন।
নিরাপত্তা:
কীটনাশক ব্যবহারের সময় নির্দেশিকা অনুসরণ করুন, মুখে কিছু নেবেন না, ও সুরক্ষা পোষাক ব্যবহার করুন। কীটনাশক প্রয়োগের পর অন্তত ৭-১৫ দিন ফসল বাজারজাত করা যাবে না।
ফলন ও সংরক্ষণ:
ফলন:
শতক প্রতি ১৪০-১৫০ কেজি, জাতভেদে ভিন্ন হতে পারে।
সংরক্ষণ:
ঠান্ডা, হাওয়া চলাচলযোগ্য স্থানে চটের ছালার উপর রাখুন। ঘষা বা চাপ এড়িয়ে সংরক্ষণ করুন।
লাউ চাষে সঠিক পরিকল্পনা ও পরিচর্যার মাধ্যমে আপনি পেতে পারেন উচ্চ ফলন ও ভালো মুনাফা। পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ চাষপদ্ধতি অনুসরণ করলে এই সবজি আপনার জন্য হতে পারে একটি লাভজনক কৃষি উদ্যোগ।