“চিলেকোঠা” এক নিভৃত আশ্রয়, স্মৃতির গন্ধমাখা ছোট্ট ঘর।

সংক্ষিপ্ত পরিচয়
শহরের কোলাহল, আধুনিকতার ব্যস্ততা আর কংক্রিটের জঙ্গলের ভেতরেও কিছু জায়গা থাকে, যেগুলো শুধু স্মৃতি দিয়ে তৈরি। ঠিক তেমনই এক জায়গার নাম — চিলেকোঠা। এটি শুধু একটা ছোট্ট ঘর নয়; এটা একটা অনুভূতি, একটা নির্জনতা, একটা পুরোনো দিনের ঘ্রাণ। আমাদের শৈশব, কৈশোর কিংবা একাকীত্বে ডুবে থাকা দুপুরগুলো চিলেকোঠার সাথেই যেন সবচেয়ে বেশি মিশে আছে।
চিলেকোঠা মানেই যেন একটা ছোট্ট নিজস্ব জগৎ
চিলেকোঠা হচ্ছে বাড়ির একেবারে উপরের দিকে ছাদের নিচে থাকা ছোট্ট ঘর। একপাশে জানালা, পুরনো কাঠের দরজা, স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে শ্যাওলা, আর ঘরের কোণে রাখা ধুলো মাখা ট্রাঙ্ক—সব মিলিয়ে যেন একটা সিনেমার দৃশ্য। কেউ কেউ একে ‘মেইড রুম’ বা ‘স্টোর রুম’ বললেও, অনেকের কাছে এটা নিজস্ব একটা জগৎ, যেখানে লুকানো থাকে নিজের গল্পগুলো।
চিলেকোঠা আর স্মৃতির গল্প
অনেকেই তো শৈশবে দাদার পুরনো বইগুলো খুঁজতে চিলেকোঠায় ঢুকেছে। কোনো বন্ধ হয়ে যাওয়া রেডিও, দাদির বিয়ের শাড়ি, অথবা খুদের বানানো ডায়েরির পাতায় লুকানো কবিতা—এসব তো আর ড্রয়িংরুমে রাখা যায় না। তাই তো চিলেকোঠা, ঘরের সবচেয়ে নিভৃত কোণ, হয়ে ওঠে স্মৃতির নিরাপদ ভাণ্ডার।
সাহিত্যে চিলেকোঠা
বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস “চিলেকোঠার সেপাই” শুনলেই এক ধরনের ভাবনার ভিড় এসে যায় মনে। চিলেকোঠা মানেই যেন একটা বোহেমিয়ান জীবন, কিছুটা নিঃসঙ্গতা, কিছুটা সৃষ্টিশীলতা। কবি-লেখকদের লেখায় বারবার এসেছে এই ঘর, যেখানে তারা একান্তে ডুবে থেকেছেন ভাবনার জগতে।
আধুনিক ঘরেও টিকে আছে চিলেকোঠা
আমাদের দাদার বা বাবার আমলের বাড়িতে চিলেকোঠা থাকলেও এখনকার আধুনিক ফ্ল্যাটেও এই ধারণা রয়ে গেছে একটু ভিন্নভাবে। এখন ছাদের নিচের ঘরকে অনেকে সাজিয়ে নিচ্ছেন:
- হোম অফিস: যাঁরা একান্তে কাজ করতে চান, তাঁদের জন্য আদর্শ।
- স্টাডি রুম: লেখাপড়া কিংবা বই পড়ার জন্য নিঃশব্দ এক আশ্রয়।
- কফি কর্নার বা টেরেস রিট্রিট: ছাদের পাশে বসে চা-কফি, একটু একান্ত সময়—চিলেকোঠা এখন হয়ে উঠেছে ছোট্ট রিফ্রেশমেন্ট জোন।
চিলেকোঠার ডিজাইন ও ব্যবহার
চিলেকোঠা ছোট হলেও এটিকে ব্যবহার করা যায় অনেকভাবে:
- পুরোনো আসবাব বা জিনিসপত্র রাখতে।
- পড়ালেখা বা লেখালেখির ঘর হিসেবে।
- অতিথির থাকার ঘর হিসেবে।
- নিজের ‘মাই টাইম’ কাটানোর ঘর হিসেবে।
কিছু কিছু ডিজাইনে জানালা বড় করে, সঠিক আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করে একে করে তোলা যায় দারুণ আরামদায়ক।
চিলেকোঠার গন্ধ ও আবেগ
যে কেউ একবার চিলেকোঠায় ঢুকলেই একটা আলাদা গন্ধ টের পাবে—পুরনো বই, কাঠ, পলিথিনে মোড়ানো জামা-কাপড়ের গন্ধ। এই গন্ধে লুকিয়ে থাকে বহু পুরনো দিনের গল্প, অভিমান, ভালোবাসা, হাসি আর কান্না। একা এক দুপুরে, একটা টেবিল ফ্যান চালিয়ে পুরোনো অ্যালবাম খুলে বসলে, চিলেকোঠার সেই গন্ধ যেন ফিরে নিয়ে যায় অনেক বছর পেছনে।
চিলেকোঠার যত্নও জরুরি
অনেক সময় আমরা চিলেকোঠাকে গুরুত্ব দিই না, ধুলাবালি জমে, ভেঙে পড়ে আলমারি, ছাদের কোনায় ফাটল ধরে। অথচ একটু যত্ন নিলেই চিলেকোঠা হয়ে উঠতে পারে পুরো বাড়ির সবচেয়ে আরামদায়ক এবং কাজের অংশ।
- নিয়মিত পরিষ্কার
- আলো ও বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা
- ন্যূনতম সাজসজ্জা
এসব মেনে চললে চিলেকোঠাও হয়ে উঠতে পারে আপনার প্রিয় ঘর।
ভবিষ্যতের চিলেকোঠা
আগামী দিনে মানুষ হয়তো আরও বেশি ব্যক্তিগত স্পেস চাবে। একান্তে কাজ, পড়াশোনা বা শুধু নিজের সাথে একটু সময় কাটানোর জন্য এমন একটি ঘর থাকবে প্রয়োজন। সেখানেই আবার ফিরে আসবে চিলেকোঠা—নতুন রূপে, আধুনিক সুবিধাসহ। LED লাইট, এয়ার কন্ডিশনার, ইনডোর প্লান্ট—সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠবে ‘আধুনিক একলা ঘর’।
পরিশেষে
চিলেকোঠা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি হচ্ছে আত্মার আশ্রয়। আমাদের যান্ত্রিক জীবনে এই ছোট্ট নিভৃত ঘরটি হতে পারে একটি মানসিক মুক্তির জায়গা। স্মৃতির সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন ঘটাতে, কিংবা একটু একান্ত সময় কাটাতে চিলেকোঠার মতো জায়গা আর কোথাও নেই।
তাই আপনি যদি নতুন একটা ঘর বানান, তাহলে একটু ভেবে দেখুন—একটা চিলেকোঠা রাখবেন কি না!
Jhinuk
May 7, 2025এখন তো চিলেকোঠা মানেই ছোট পরিবার ভাড়া দেয়ার বাড়তি জায়গা!
এখন আর চিলেকোঠার আবেদন আগের মতো কোথায়!!
Sheikh Farid Uddin
May 7, 2025কথাটা সম্পূর্ণ সঠিক। এখন তো চিলেকোঠা মানে বাড়তি আয়ের উৎস। আপনি চাইলে আপনার চিলেকোঠা নিজের মতো করে সাজাতে নিতে পারেন?