“বজরা শাহী জামে মসজিদের” ইতিহাস, সৌন্দর্য আর স্থাপত্যের এক অপূর্ব মিলন।

সংক্ষিপ্ত পরিচয়
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন, যেগুলো শুধু ইতিহাসই নয়, সৌন্দর্য আর সংস্কৃতির গল্পও বলে। তেমনই এক স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন হচ্ছে বজরা শাহী জামে মসজিদ। আপনি যদি কখনও নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলায় যান, তবে এই মসজিদ না দেখে ফেরা সত্যিই এক বড় আফসোস হবে।
মসজিদের নির্মাণের পেছনের ইতিহাস
নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার বজরা ইউনিয়ন একসময় ছিল জমিদারশাসিত এলাকা। সেই সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন খাজা আমিরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী। তিনি ছিলেন শিক্ষিত, ধর্মপরায়ণ এবং সংস্কৃতিমনস্ক এক ব্যক্তি। সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও মুসলিম স্থাপত্যকলার বিকাশে তাঁর আগ্রহ ছিল ব্যাপক।
খাজা আমিরউদ্দিন আহমদ চৌধুরীর পিতামহ খাজা ইয়ার মোহাম্মদ চৌধুরী ছিলেন একজন প্রভাবশালী ও ধর্মভীরু ব্যক্তি। তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখতে এবং এলাকাবাসীর জন্য একটি স্থায়ী ইবাদতের স্থান গড়ে তুলতে খাজা আমিরউদ্দিন ১৯১০ সালে এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন।
মসজিদের নাম “শাহী জামে মসজিদ” রাখা হয়েছিল একদিকে এর আভিজাত্যপূর্ণ স্থাপত্যশৈলীর কারণে, অন্যদিকে এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ জামে মসজিদ হওয়ায়। ‘শাহী’ অর্থ রাজকীয়—এবং সত্যিই এটি রাজকীয় স্থাপত্য ও গৌরবের প্রতীক।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একটি ব্যতিক্রমধর্মী মসজিদ
ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশে (তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে) অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, তবে বেশিরভাগ মসজিদেই তখন সাধারণ নকশা ও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহৃত হতো। সেই তুলনায় বজরা শাহী জামে মসজিদ ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। এটি শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং স্থাপত্যিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকেও অনন্য।
কেন ব্যতিক্রম?
- স্থাপত্যশৈলীর বৈচিত্র্য
এই মসজিদে মুঘল স্থাপত্যের গাম্ভীর্যের পাশাপাশি ইউরোপীয় রেনেসাঁ শৈলীর ছোঁয়া দেখা যায়। একদিকে উঁচু গম্বুজ ও মিনার, অন্যদিকে দরজার খিলান, রঙিন কাঁচ, টাইলস আর কারুকাজে ইউরোপীয় ঘরানার প্রভাব স্পষ্ট। এ রকম মিলন সেই সময়কার গ্রামীণ মসজিদে একেবারেই বিরল ছিল।
- উন্নত নির্মাণসামগ্রী ও কারিগরি
শুধু স্থানীয় কারিগর নয়, মসজিদ নির্মাণে কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও লক্ষ্ণৌ থেকে দক্ষ কারিগর আনা হয়েছিল। ব্যবহার করা হয়েছিল বিদেশি কাঁচ, টাইলস ও উন্নত মানের চুন-সুরকি। এসব উপাদান সাধারণ মসজিদে তেমন দেখা যেত না।
- জমিদার পৃষ্ঠপোষকতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা
অনেক মসজিদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছোট পরিসরে নির্মিত হলেও, বজরা শাহী জামে মসজিদ নির্মিত হয়েছিল জমিদার খাজা আমিরউদ্দিন আহমদ চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায়, বিশাল ব্যয়ে। এটি ছিল তাঁর পরিবারের মর্যাদা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ।
- সামাজিক ও ধর্মীয় মিলনকেন্দ্র
এই মসজিদ ছিল শুধু নামাজের স্থান নয়, বরং এলাকাবাসীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিলনকেন্দ্র। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আলোচনা, মিলাদ মাহফিল, এমনকি ছোটখাটো সালিশও এখানে বসত।
- সময়কে অতিক্রম করে টিকে থাকা স্থাপনা
শত বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, তবু মসজিদটি আজও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় জনগণের ভালোবাসা, ঐতিহ্য রক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের ফলে এটি আজও কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পরিশেষে
বজরা শাহী জামে মসজিদ শুধুই একটি মসজিদ নয়, এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্থাপত্য ও ধর্মের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। এই মসজিদ আমাদের অতীত গৌরবের স্মারক। দেশের যেকোনো পর্যটক, ইতিহাসপ্রেমী কিংবা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি—যদি কখনো নোয়াখালী ভ্রমণে যান, তবে এই মসজিদটি না দেখে ফেরা এক বিশাল বঞ্চনা।